নিজস্ব প্রতিবেদক:::
আজ ঐতিহাসিক ভয়াল ২৯ এপ্রিল! স্বজন হারাদের আঁৎকে উঠার দিন। এখনো ডুকরে ডুকরে কাঁদে প্রিয়জনের শোক তুলে স্বজন হারা লোকজন। গণহারে কবর হয়েছিল, লাখে লাখে মরেছে মানুষ। মানুষের লাশ আর লাশ ভেসে এসেছে উপকূলে। ট্রাজেডির ৩১ বছর পেরিয়েও চট্টগ্রাম উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষদের স্বজন হারানোর আহজারী থামেনি আজোও। এই দিনে বাঁশখালীতে প্রায় ১২ হাজার লোকের প্রাণহানি হয়েছে। বাঁশখালী উপকূলের হতভাগ্যরা এখনো বুঝে পায়নি স্বপ্নের টেকসই বেড়ীবাঁধ। নিত্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের শিকার উপকূলবাসী থাকে নানা শংকায় আর উৎকণ্ঠায়। বেড়ীবাঁধ না থাকায় উপকূলের মানুষজন প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে হারাচ্ছে মাথাগুঁজে থাকার একমাত্র বাপ-দাদার ভিটেমাটি। কারো কারো বসতঘর সমুদ্রের অতলে হারিয়ে গেছে বহু বছর আগে।
উপকূলীয় অঞ্চলের স্বপ্নের বেঁড়ীবাধ আজোও স্বপ্নের মতো অধরাই থেকে গেল। বেঁড়ীবাধ সংস্কারের কাজ বুঝে পায়নি উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজন। বর্ষায় ডুবে, প্রাকৃতিক সাইক্লোন, বন্যায় তাদের হারাতে হয় বেঁচে থাকার নানা ফসলি জমি ও লবনের মাঠ। প্রাকৃতিক দূর্যোগের ভয়াবহ সংকটের কথা মনে করে তারা আৎকে উঠে এখনো। প্রলয়ঙ্করি এই ধ্বংসযজ্ঞের ৩১ বছর পার হতে চলেছে। এখনো স্বজন হারাদের আর্তনাদ থামেনি। ঘরবাড়ি হারা অনেক মানুষ এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারেনি। এই ঘুর্ণিঝড়ে বাঁশখালীতে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ। এখনো বাঁশখালীর উপকূলী এলাকার লোকজন বেড়িবাঁধেরর কাজ পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝে পায়নি। বাঁশখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থায়ী বেড়ীবাঁধ নির্মাণ করা হলেও অনেক জায়গা এখনো অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগরের খানখানাবাদ ইউনিয়ন উপকূলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে কদম রসূল ও হাছিয়াপাড়া অংশে পাঁচ চেইন বেড়ীবাঁধ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এখানো অতিরিক্ত জোয়ার জলোচ্ছ্বাসে লোকালয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে। বর্ষা মৌসুমে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের হাজার হাজার পরিবার পানিবন্ধীসহ ফসলাদীর ক্ষতি হওয়া আশঙ্কা রয়েছে। এখনো উপজেলার খানখানাবাদ ইউনিয়নের কদমরসূল, গন্ডামারা পশ্চিম বড়ঘোনা ও গন্ডামারা এলাকায় বেড়ীবাঁধেরর ভাঙন এলাকার কাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন পোল্ডাওে স্থায়ী ব্লক বসিয়ে বাঁধ নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।সম্প্রতি শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে উপকূলবাসীর স্বপ্নের বেড়ীবাঁধ, তবে স্বপ্ন স্বপ্নের মতোই অধরাই থেকে গেল। অনুন্নত পাথর ঢালাই, সমুদ্রের তট থেকে কাঁচা বালি নিয়ে নড়বড়ে যৎ সমান্য কাজ হয়েছে বেড়ীবাঁধের। স্থানীয়রা জানান, এই বেড়ীবাঁধ যেভাবে হয়েছে তা যেনো তাসেরঘর। অতিবৃষ্টি কিংবা বর্ষার ঢলে, সমুদ্রের জোয়ারের ঢেউয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এখনো বাঁশখালী উপকুলের প্রেমাশিয়া, খানখানাবাদ, সরল, বাহারছড়া, ইলশা, কদমরসূল, গন্ডামারা-বড়ঘোনা, ছনুয়া সহ সমুদ্র উপকুলের নিম্নাঞ্চলেরর মানুষ দূর্যোগকালীন সময়ে আতংকে থাকে। এ উপজেলার মানুষ এখনো প্রতি বর্ষায় নির্ঘুম রাত কাটান। প্রাকৃতিক বৈরী আবহাওয়ার সাথে সংগ্রাম করেই উপকূলবাসীর জীবন কাটে। অরক্ষিত বেড়ীবাঁধের কারণে লোকালয়ে জোয়ারের পানি ডুকে তলিয়ে যায় নির্মাঞ্চল। শত শত পরিবার পানিবন্ধ হয়ে পড়ে। এভাবে উদ্বেগ উৎকন্ঠার ৩৪ বছর পার হলেও স্থায়ী টেকসই বেড়ীবাঁধের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি।
ট্রাজেডির ৩৪ বছর: আজ ঐতিহাসিক ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল। ভয়াল একটি রাত! এদিন ‘ম্যারি এন’ নামক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় পূরো উপকূলীয় অঞ্চল। লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে। নদী-নালা, ডোবায়, খাল-বিল, সমুদ্রে ভেসেছিল মানুষের লাশ আর লাশ। গরু, মহিষ, ভেড়ার মরদেহের স্তুপ যেনো ভয়াল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংসস্তপে পরিণত হয়েছিল। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই আঘাতের নিদারুণ দৃশ্য। প্রাকৃতিক দূর্যোগের এতোবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এদেশের মানুষ এর আগে আর কখনো সম্মুখীন হয়নি। পরদিন বিশ্ববাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ধ্বংসলীলা দেখে। কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব বিবেক। নির্বাক হয়ে থাকিয়ে ছিলো জাতী। স্বজন হারানোর অস্থিরতায় বোবা কান্নায় ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলো সমগ্রদেশের বিবেক। বাংলাদেশে আঘাত হানা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে অন্যতম।
জানা যায়, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল রাতে বাংলাদেশে-র দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা এ ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ২৫০ কিমি (১৫৫ মাইল/ঘন্টা)। ঘূর্ণিঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ¦াসে আনুমানিক ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। এ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় আর এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় পূরো উপকূল। স্মরণকালের ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার। ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৪২ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরো বেশি। মারা যায় ২০ লাখ গবাদিপশু। গৃহহারা হয় হাজার হাজার পরিবার। ক্ষতি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। উপকূলবাসী আজও ভুলতে পারেনি সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি। শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চল মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ।
উল্লেখ্য, এই ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় প্রাণহানি হয়েছিলো প্রায় ৮ হাজার লোকের। স্বজন হারানোর বেদনা এখনো ভুলতে পারেনি নিহতের স্বজনেরা। এছাড়াও কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, পেকুয়া, উখিয়া ও টেকনাফ সহ উপকূলের বিভিন্ন এলাকার স্বজন হারানো মানুষ গুলো এখনো ভয়াল ২৯ এপ্রিলকে স্মরণ করে দুঃসহ বেদনার মধ্যে দিয়ে। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার দীর্ঘ ৩৩ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতের কোলঘেঁষে গড়ে উঠা হাজার হাজার উপকূলবাসী বর্ষা মৌসুম আসলে প্রাকৃতিক বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করলে পূর্বের সেই ভয়াল স্মৃতিকে মনে করে স্বজন হারাদের উৎকণ্ঠায় জীবন পার হয়।