শিব্বির আহমদ রানা::
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ভূমি অফিস যেন দালালদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। উপজেলার চাম্বল ভূমি অফিসটি শীলকূপ, গন্ডামারা, শেখেরখীল, ছনুয়া, পুইঁছড়ি ইউনিয়নসমূহের ১৮টি মৌজা নিয়ে গঠিত। এই ইউনিয়ন ভূমি অফিসে দালালদের সহায়তা ছাড়া একটি ফাইল নড়া দূরের কথা, কোনো কাজই হয় না। ভূমিসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের মূল্য তালিকা সংবলিত সাইনবোর্ড ও কাগজ সরবরাহের নির্ধারিত সময় উল্লেখ কেবলই লোক দেখানো। সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী সেবা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। লোকমুখে প্রচলিত শুধুমাত্র দালালদের মাধ্যমে এখানে প্রতিটি কাজ সম্পন্ন হয়। এ ভূমি অফিসে প্রায়শই দালাল ও তহসিলদারকে একসাথে একই টেবিলে বসে কাজ করতে দেখা যায়। দালালদের মাধ্যমে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ গুণ টাকা বেশি দিয়ে এখানে প্রতিটি কাজ করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সেবাগ্রহীতারা। এভাবে দিনের পর দিন চাম্বল ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সেবাগ্রহীতারা হয়রানির শিকার হন দালালদের দ্বারা।
সম্প্রতি সরেজমিনে চাম্বল ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরিদর্শন করে দেখা যায়, ‘চাম্বল ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহসিলদার মহিউদ্দিন ও বাঁশখালীর সুপরিচিত ভূমি দালাল আক্তার হোসেনকে একই টেবিলে পাশাপাশি বসে বিভিন্ন নথিপত্র নাড়াচাড়া করতে দেখা যায়। এ সময় ভূমি অফিসের এক কর্মচারীকে দালাল আক্তার হোসেনকে সহযোগিতা করতেও দেখা যায়। অপরদিকে ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা সেলিম উল হক সিকদারকে ভূমি অফিস ভবনের পিছনে সেবাগ্রহীতাদের সাথে আলাপ করতে দেখা যায়। পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এক প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন কেড়ে নেন তিনি। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের ভিডিয়ো করতে বলেন এবং লাঞ্ছিত করেন। পরে সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ার হুমকিও প্রদান করেন তিনি।'
এ সময় ভূমি অফিসের ভিতরে উপস্থিত চাম্বল ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সর্বেসর্বা নামে পরিচিত দালাল খোরশেদুল ইসলামের দেখা পাওয়া যায়। তিনি এখানে কি করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপজেলা ভূমি অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এখানে এসেছেন। এখানে তিনি মাস্টার রোলে চাকরি করেন। কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এখানে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর না দিয়ে উপ-সহকারী কর্মকর্তাকে এদের দেখেন বলে ওই জায়গা থেকে ছটকে যান।'
এ সময় চাম্বল ইউনিয়ন ভূমি অফিসে উপস্থিত সেবাগ্রহীতা হাফেজ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নামজারি খতিয়ান দ্রুত করার জন্য অফিসের কর্মকর্তাদের চা-নাস্তার কথা বলে দালাল খোরশেদ তার কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা নেন। এ সময় পাশে উপস্থিত থাকা তহসিলদার বিষয়টি শুনে খোরশেদের কাছ থেকে ওই তিন হাজার টাকা ফেরত নিয়ে দিবেন বলে জানান।'
নাজিম উদ্দিন নামে আর এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমি একটি খতিয়ান করতে গিয়েছিলাম। ওই সময়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার কারণে ওনারা সেটা হবে না বলে জানায়। এ সময় আমার পাশে বসা এক বৃদ্ধ লোক আমাকে জানান, তার কাছে খতিয়ানের জন্য ১৫ হাজার টাকা চাইছিলো। পরে ১০ হাজার টাকা দিয়ে অফিসের পিয়ন পরিচয়ে সঞ্জীব নামে একজন সেটা করে দেন।'
ভুক্তভোগী শেখেরখীল ইউপির মো. গোলাম মোস্তাফা বলেন, ‘আমাদের বাড়ির মাঝখানে একটি সরকারি খাস (রাস্তা) জমি ছিল। ওই জমিটা দালাল খোরশেদ প্রভাব কাটিয়ে নাল করে তার চাচার নামে খতিয়ান করে ফেলেন। এলাকায় খোরশেদ নিজেকে চাম্বল ভূমি অফিসের একজন কর্মকর্তা পরিচয় এবং অ্যাসিল্যান্ডের সাথে তার ওঠাবসা আছে বলে পরিচয় দেয়। আমরা তার বিরুদ্ধে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউএনও ও ডিসি মহোদয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাম্বল ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহসিলদার মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমি মাত্র দুইমাস হয়েছে যোগদান করেছি। আমি নিজেও দালাল মুক্ত ভূমি অফিস চাই। আমি নতুন হওয়াতে কে দালাল, কে সেবাগ্রহীতা সেটা বুঝতে পারিনা। যে দুইজনের কথা বলেছেন তারা প্রায়শই এখানে আসে, তবে তারা যে দালাল সেটা জানতাম না। আর ওনারা এই অফিসের কোন কর্মচারীরা না। অফিসে যে কয়জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে তাদের তালিকা আপনাদের দিচ্ছি।'
এ সময় অফিসের উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা সেলিম উল হক আমাদের এক প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়ার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টা ভুলে যান। এটা ভুল বুঝাবুঝি ছিল। আমরা একে-অপরের সাথে মিলেমিশে থাকতে চাই। এখন রমজান মাস তাই আপনাদের চা-নাস্তা খাওয়াতে পারছিনা। একসাথে বসে চা খেতে পারলে ভালো লাগতো বলেও বলেন তিনি।'
এ সময় ভূমি অফিস ত্যাগ করার আনুমানিক ২০ মিনিট পর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জসিম উদ্দীন এক প্রতিবেদকের মোবাইলে কল করে জানতে চান আপনারা কি চাম্বল ভূমি গেছিলেন? প্রতিবেদক হ্যাঁ বললে, তিনি বলেন, কি কাজ ওখানে। আপনাদের কাছে অভিযোগ করছে কে। ভিডিও থাকলে পাঠায় দেন। আপনারা ওখানে গেছেন যে আমাকে বলে গেছেন। আচ্ছা ওখানে যে ভিডিওগুলো করছেন ওইগুলো আমাকে পাঠান বলে কল কেটে দেন।' পরে রাত ৮টার দিকে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সরকারি অফিসে কর্ম পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগ তুলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি প্রদান করেন।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আপনারা যে আমার অফিসে গেছেন আমার অনুমতি নিয়েছেন? কারও বিরোদ্ধে অভিযোগ থাকলে আমাকে লিখিতভাবে অভিযোগ দিবেন। দালালদের ছবি তোলার কারনে চাম্বল ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী সেলিমুল উল হক সংবাদকর্মীর মোবাইল ফোন কেড়ে নিতে পারে কিনা এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কোনো সদুত্তর দেন নি তিনি। কোনো কিছু বলার থাকলে লিখিতভাবে বলতে হবে।'
ক্যাপশন: চাম্বল ভূমি অফিসের তহসিলদারদের পাশে বসে সেবা দিচ্ছেন দালাল আক্তার হোসেন।
প্রকাশক ও সম্পাদক : শিব্বির আহমদ রানা, ফোন নম্বর: ০১৮১৩৯২২৪২৮, 𝐄-𝐦𝐚𝐢𝐥: 𝐛𝐚𝐧𝐬𝐡𝐤𝐡𝐚𝐥𝐢𝐬𝐚𝐧𝐠𝐥𝐚𝐩@𝐠𝐦𝐚𝐢𝐥.𝐜𝐨𝐦
অস্থায়ী ঠিকানা: স্মরণিকা প্রিন্টিং প্রেস। উপজেলা সদর, জলদী, বাঁশখালী, পৌরসভা, চট্টগ্রাম
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত